SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - NCTB BOOK

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি। আমরা জানি যে, ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা উষ্ণায়নের কারণে সারা পৃথিবীতেই আজ জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের ফলে উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে শুষ্ক মৌসুমে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায়। এছাড়া বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি ও অত্যধিক খরা, শিলাবৃষ্টি, ভূমিক্ষয়, টর্নেডো, সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। শীত মৌসুমে হঠাৎ শৈত্য ও উষ্ণ প্রবাহ এবং ঘন কুয়াশা লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া এ দেশে সংগঠিত প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এ দুর্যোগ সংঘটনের কারণ । বাংলাদেশের জীবন ও অর্থনীতির উপর এইসব দুর্যোগের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব ;
• বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব;
• দুর্যোগের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব;
• দুর্যোগের ধরন উল্লেখ করতে পারব;
• বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা- ভূমিকম্প, সুনামি, ভূমিধস ও অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
• বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ বর্ণনা করতে পারব ;
• বাংলাদেশের জীবন ও অর্থনীতির উপর এসব দুর্যোগের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব;
• প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগে করণীয়, জীবন ও জীবিকা রক্ষায় উপযোগী পদক্ষেপের পরামর্শসহ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারব ;
• পরিবেশ বিষয়ে সচেতন হব।

Content added By
অক্সিজেন কমে যাওয়ায়
মেঘের উৎপাদন কম হওয়ায়
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে
কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ায়

পৃথিবীর বুকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে পানি, বায়ু ও অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠা প্রাণ-উপযোগী পরিবেশের কারণে। উষ্ণায়নের ফলে সেই পরিবেশই ভয়ানকভাবে বিপন্ন হচ্ছে। এখন জানা যাক, এই ‘উষ্ণায়ন’ কী । বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ একদিকে যেমন তার জীবনকে করেছে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে করেছে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভারসাম্যহীন । জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, বৃক্ষনিধন ও ইঞ্জিনচালিত যানবাহনসহ বড় বড় শিল্প-কারখানার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সৃষ্টি হয় নানা সমস্যার । সমস্যাগুলোর একটি হলো গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া। এটি একটি জটিল সমস্যা। গ্রিনহাউস মূলত কতগুলো গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি আচ্ছাদন। গ্রিনহাউস গ্যাসকে তাপ বৃদ্ধিকারক গ্যাসও বলে। এই গ্যাস পৃথিবীর চারপাশে বায়ুমণ্ডলে চাদরের মতো আচ্ছাদন তৈরি করে আছে।

পাশের চিত্রটি লক্ষ কর। এখানে প্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীকে ঘিরে চাদরের মতো একটি আচ্ছাদন তৈরি করেছে। তার ফল কী হয়েছে? সূর্যের তাপ এই চাদর শোষণ করে এবং তা পৃথিবীপৃষ্ঠে ছড়িয়ে দেয়। পৃথিবী পৃষ্ঠ দ্বারা গৃহীত এ তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবে রাজের ৰেলা প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায় এবং এভাবেই পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে নির্দিষ্ট কিছু গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিফলিত তাপ সম্পূর্ণভাবে মহাশূন্যে মিলিয়ে না যেয়ে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে। এভাবেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। একেই বলা হয় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এই উষ্ণায়নের ফলে বায়ুমণ্ডল ও পৃথিবী ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বাড়ছে।

Content added || updated By

বায়ুর মূল উপাদান হলো নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। এছাড়া ৰাতে সামান্য পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড আছে। আরও আছে জলীয় বাষ্প ও ওজোন গ্যাস। বায়ুমণ্ডলের এই গৌণ গ্যাসগুলোকেই গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এসব গ্যাস ছাড়াও মনুষ্য সৃষ্ট সিএফসি (ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন), এইচসিএফসি (হাইড্রো ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন), হ্যালন ইত্যাদিও প্রিনহাউস গ্যাস। এই গ্যাসগুলোর মধ্যে গত এক শতাব্দীতে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। একইভাবে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণও শতকরা ১৯ ভাগ এবং মিথেনের পরিমাণ ১০০ভাগ বেড়েছে। যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। এছাড়া অন্যান্য কারণও রয়েছে।

আমরা যেসব দ্রব্য ব্যবহার করি, যেমন রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, প্লাস্টিক, ফোম, এরোসল প্রভৃতির ফলেও বায়ুমণ্ডলে উৎপন্ন হচ্ছে এক ধরনের প্রিনহাউস গ্যাস (এইচসিএফসি)। এই গ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রত হয়। বায়ুমণ্ডলের অনেকগুলো স্তর আছে। ভার মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী ত্তর ট্রপোস্ফেয়ার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার গড় উচ্চতা ১২ কি.মি.। এর পরের স্তর হলো স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। তারপরের স্তরটি হলো ওজোন স্তর, যা ২০ কি. মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। ওজোন স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগতকে রক্ষা করে। ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণে ভূপৃষ্ঠে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব শতকরা পাঁচ ভাগ বৃদ্ধি পেরেছে। এটাও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণ।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অধিক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে পরিবেশ নষ্ট করছে। তাছাড়া এসব দেশ পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করে, যা থেকে প্রচুর বর্জ্য সৃষ্টি হয়। এই বর্জ্যও গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি করছে, তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এর ভূমিকা অতি সামান্য। শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কালো ধোঁৱা থেকেও প্রচুর পরিমাণে পারদ, সিসা ও আর্সেনিক নির্গত হয় । এটাও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ।

মহাসমুদ্রকে পৃথিবীর মানব দেহের ফুসফুসের সাথে তুলনা করা যায়। বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে মহাসমুদ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিক্ষেপ করার ফলে ভা দূষিত হচ্ছে এবং এ দূষিত বাষ্প বাতাসে মিশ্রিত হয়েও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশেও এক সময় বহু নদী-নালা, খাল-বিল ও হাওর-বাওর ছিল যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এখন এসব নদী-খাল-বিল শুকিয়ে গিয়েছে কিংবা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অনেক নদী ও খাল বর্জ্য ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এভাবে অনেক অনুন্নত দেশেই এসব নদ-নদীর অপব্যবহার হওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় ।

পরিবেশ দূষণের পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বন উজাড়করণ। আমরা জানি, সবুজ উদ্ভিদ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং আমাদের জন্য অক্সিজেন ড্যাপ করে। কিন্তু ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন বা বন উজাড়করণের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী সিএফসি গ্যাস অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বৰ্তমান বিশ্বে ব্যাপক হারে নগর গড়ে উঠেছে। মানুষ কাজের খোঁজে শহরে ছুটছে। ফলে শহরে জনসংখ্যার চাপ ও বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব যানবাহনের নির্গত কালো ধোঁয়া হচ্ছে কার্বন-ডাই- অক্সাইড। তাছাড়া শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়াও নগরের বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এটিও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা কারণ।

কৃষিতে যান্ত্রিক সেচ, নাইট্রোজেন সার, কীটনাশক প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এসবের ফলেও বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতি হয়। যার প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৰাড়ছে।

আমরা সপ্তম শ্রেণিতে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জেনেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এর ফলে পৃথিবীর সর্বত্র আজ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও তা থেকে মুক্ত নয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে বাংলাদেশে পরিবেশ ও জীবনযাত্রায় যেসব ক্ষতি হতে পারে তা হলো :

সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ে। আর সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রভাবে পাছপালা, মৎস্যখামার ও শস্যক্ষেতের ক্ষতি হয়। ইতোমধ্যেই এর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ক্ষতিখণ্ড হয়েছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। জমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। এ কারণে এসব অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনও কমে গেছে। অনেক রকম মিঠা পানির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা। এর প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকার উপর। জীবিকার টানে মানুষ শহরমুখী হয়। শহরের উপরও চাপ বাড়ছে।

সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় উঁচু জোয়ারের সৃষ্টি হয়। যা জলোচ্ছ্বাসের আকার ধারণ করে। আবার সমুদ্রে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে সাইক্লোনের তীব্রতা বেড়ে যায়। আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ 'আইলা' ও 'সিডর' এর নাম শুনেছি। এ দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। খাবার পানির তীব্র অভাব দেখা দেয়। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বন নষ্ট হয়েছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে আসার ফলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন প্রকারের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হয়। ক্যান্সার, চর্মরোগসহ নানা ধরনের নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যেমন-বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুকরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট বন্যা, খরা, লবণাক্ততা প্রভৃতি কারণে গবাদি পশুর খাদ্যের অভাব হবে। বাড়বে বিভিন্ন ধরনের রোগ। এসব ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

কাজ- ১ : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কী কী কারণে ঘটে, উল্লেখ করো।

কাজ- ২ : বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে মানুষ, পরিবেশ ও জীবজন্তুর কী কী ক্ষতি হয় এবং হতে পারে? উল্লেখ করো।

Content added || updated By

 কোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট অবস্থা যখন অস্বাভাবিক ও অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে এবং এর ফলে শস্য ও সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তাকে দুর্যোগ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। দুর্যোগ দুই ধরনের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকস্মিকভাবে ঘটে এবং তার উপর সাধারণত মানুষের হাত থাকে না। কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ অনেকটা মানুষের কর্মকাণ্ডের ফল এবং মানুষ সচেতন ও সতর্ক থাকলে তা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। মানুষের অসচেতনতা বা দূরদৃষ্টির অভাবে যে দুর্যোগ সৃষ্টি হয় এবং যা মানুষের প্রাণহানি ঘটানোর পাশাপাশি তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে, তাকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বলে । যেমন : যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বনভূমি বিনাশ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, মরুকরণ, অগ্নিকাণ্ড প্রভৃতি। অন্যদিকে প্রাকৃতিক কোনো দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় যখন কোনো জনপদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তোলে তখন তাকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলি । যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, খরা, নদীভাঙন, সুনামি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি।  

কাজ- ১ : দুর্যোগ বলতে কী বোঝায়?

কাজ- ২ : প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ৫টি করে উদাহরণ দাও।

Content added || updated By

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত প্রাকৃতিক কারণে ঘটে থাকে। একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ুগত প্রভাব, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তথা সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এ দুর্যোগ ঘটে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, ভূমির গঠন, নদী-নালা ইত্যাদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসাবে বিবেচনা করা যায়।

ভৌগোলিক অবস্থান : ভৌগোলিক অবস্থানই আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ। নদীমাতৃক প্রায় সমতল এদেশটির উত্তরে হিমালয় পর্বত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীসমূহের উৎস হয় ভারতে না হয় নেপালে। দক্ষিণাঞ্চলে পাহাড়, পর্বত, টিলা বা এমন কোনো প্রাকৃতিক বাধা নেই যা ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

ভূমির গঠন : বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূভাগ প্লাবন সমভূমি দ্বারা গঠিত। এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার প্লেটের (পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিদ্যমান বিশাল গাভ) সীমানার কাছে অবস্থিত হওয়ায় এদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত।

জলবায়ু : বাংলাদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থান করার এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এর ফলে এখানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের যতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। নদী-নালা : বাংলাদেশের উপর দিয়ে অসংখ্য নদী-নালা আঁকাবাঁকা হয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এখানে বন্যা ও নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে।

কাজ : মানচিত্রে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ভিত্তিক দুর্যোগ এলাকা চিহ্নিত করো।

Content added By

প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট দুর্যোগ যে কোনো দেশ বা সমাজের জন্য ভয়াবহ ও ক্ষতিকর। এ দুর্যোগ মানুষের জীবন ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বন্যা অন্যতম। ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৪ ও ২০০৯ সালের সংগঠিত বন্যা ছিল ভয়াবহ। এসব বন্যার কারণে ক্ষেতের ফসল, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, গাছপালা, মাছের খামার, শিল্প-কারখানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তাছাড়া বন্যার কারণে বাড়িঘর ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন হয়েছিল। প্রায় প্রতি বছর আমাদের দেশে সাধারণত শতকরা ২০ ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। কিন্তু দুর্যোগ অস্বাভাবিক আকার ধারণ করলে দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ এলাকাও ডুবে যাওয়ার আশংকা থাকে । বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়- আমাদের দেশের নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। বন্যা ও বন্যা পরবর্তীকালীন সময়ে খাবার তৈরি, পানি সংগ্রহ, নির্ভরশীল সন্তানদের পরিচর্যাসহ বৃদ্ধদের নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে নারীরাই অধিক ভূমিকা রাখে। ফলে তাদের এসব সমস্যা মোকাবিলায় নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের কারণে এদেশের দরিদ্র মানুষই অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দরিদ্রতার কারণে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার সামর্থ্য হারায়। তাছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই সাধারণত দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে বলে দুর্যোগের প্রথম শিকার হয় তারা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বায়ু ও পানি দূষিত হয়, যা জনজীবনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে । বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো প্রভৃতি দুর্যোগের ফলে আবর্জনা, জীবজন্তুর মরদেহ, মলমূত্র প্রভৃতি আমাদের আশেপাশের পানি ও বায়ুকে দূষিত করে। ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

দুর্যোগজনিত পানি দূষণের কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস, চর্মরোগ, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অসুখ দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মানুষ পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। তবে দুর্যোগকালে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা অধিক দুর্ভোগের শিকার হয় ।

২০০৭ সালে সংগঠিত সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলায় আক্রান্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ সহায়সম্বল হারিয়ে আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এসব বিপর্যয়ে হাজার হাজার মানুষ বসতবাড়ি, সহায়-সম্বল হারিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়। এ ধরনের দুর্যোগে অনেক প্রাণহানি এবং প্রচুর ফসলহানি হয়। আমাদের দেশে শহরকেন্দ্রিক বস্তি গড়ে উঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রবল বাতাসে উপকূলীয় গাছপালার অনেক ক্ষতি হয়। আবার জলোচ্ছ্বাসের কারণে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায় ফলে অনেক মাছ মারা যায়। এই লবণাক্ত পানির কারণে জমির উর্বরাশক্তি কমে যায় এবং এসব জমিতে ফসল হয় না। তাছাড়া লবণাক্ত পানির কারণে মিঠাপানির মাছের প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যায়। নদী ভাঙ্গনেও অনেক বনাঞ্চল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় যা প্রকৃতির ভারসাম্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কাজ : দুর্যোগ আমাদের পারিবারিক জীবনের উপর কী প্রভাব ফেলছে তা চিহ্নিত করো।

Content added || updated By

আমরা আগেই জেনেছি, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোধ করা যায় না, তবে উপযুক্ত পূর্বপ্রস্তুতি এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে এসব দুর্যোগে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব । বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় করণীয়

দুর্যোগপূর্ব করণীয়

১. যথাসম্ভব উঁচু জায়গায় বসতভিটা, গোয়ালঘর ও হাঁস-মুরগির ঘর তৈরি করতে হবে।

২. নদী তীরবর্তী এলাকায় বেড়ি বাঁধের ভিতরে এবং সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বেস্টনির ভিতরে বসতভিটা তৈরি করতে হবে।

৩. বাড়ির চারপাশে বাঁশঝাড়, কলাগাছ, ঢোলকলমি, ধৈঞ্চা ইত্যাদি গাছ লাগাতে হবে। এসব গাছ বন্যার স্রোত অনেকটা প্রতিরোধ করতে পারে।

8. ঘরের ভিতরে উঁচু মাচা বা পাটাতন তৈরি করে তার উপর খাদ্যশস্য, বীজ ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে ঘরে পানি ঢুকলেও এগুলো নষ্ট না হয় ।

৫. প্রতিটি পরিবারে দা, খুন্তি, কুড়াল, কোদাল, ঝুড়ি, নাইলনের দড়ি, বাঁশের চাটাই, টিনের ভাঙা টুকরা, আলগা চুলা, রেডিও, টর্চ লাইট ও ব্যাটারি জোগাড় করে রাখতে হবে।

৬. পুকুরের পাড় উঁচু করতে হবে এবং টিউবওয়েল ও ল্যাট্রিন যতটা সম্ভব উঁচু স্থানে বসাতে হবে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত পাইপ লাগিয়ে টিউবওয়েলের মুখ উঁচু করতে হবে।

৭. শুকনা খাবার যেমন চিড়া, মুড়ি, থৈ, গুড় এবং প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র বিশেষ করে খাবার স্যালাইন ঘরে মওজুদ রাখতে হবে। দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য কিছু পরিমাণ গোখাদ্যও সংরক্ষণ করতে হবে।

৮. পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে সাঁতার শেখার ব্যাপারে উৎসাহী করতে হবে।

৯. বন্যা বা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মৌসুমের আগে বসতভিটা মেরামত বিশেষ করে খুঁটি মজবুত করতে হবে। 

১০. নিকটবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রের খোঁজ রাখতে হবে।

১১. সঞ্চয়ের মনোভাব পড়ে ভুলতে হবে।

১২. সতর্ক সংকেত ও তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে হবে। 

১৩. এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে ।

১৪. এলাকার ক্ষতিপ্রত্ত বাঁধ, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি মেরামতের জন্য সামাজিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে।

১৫. এলাকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, সামাজিক কমিটি, স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়মিত সভা করে দুর্যোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে হবে।
 

দুর্যোগকালীন করণীয়

১. বন্যা শুরু হলে নিয়মিতভাবে পানি বাড়া বা কমা | পর্যবেক্ষণ কিংবা এসম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

২. বন্যার সময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পলিখিন বা পানিরোধক প্যাকেটে মুড়ে ঘরের চালের নিচে পাটাতনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে খাবার পানি কলসিতে ভরে ভালো করে ঢেকে পলিথিন দিয়ে বেঁধে এবং সেই সাথে কিছু শুকনো খাবার যেমন চিড়া, মুড়ি, গুড় একটি পাত্রে ভরে ভালো করে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে।

৩. গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগিগুলোকে উঁচু স্থানে সরিয়ে রাখতে হবে।

৪. বন্যায় বাড়িঘর ডুবে গেলে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে ১, ২, ৩ ও ৪ নং সতর্ক সংকেত পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে যাবার প্রয়োজন নেই। তবে ৫নং বিপদসংকেত শোনার পর শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও মেয়েদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিতে হবে এবং মহাবিপদ সংকেত শোনার পর সবাইকে অবশ্যই আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকলে কাছাকাছি পাকা, উঁচু বা বহুতল বাড়ি, স্কুল-কলেজ বা অন্য প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে হবে।

৫. দুর্যোগে বিশুদ্ধ বা নিরাপদ পানি পান করতে হবে। যে টিউবওয়েলের মুখ পানিতে ডোবেনি এমন টিউবওয়েলের পানি পানের জন্য নিরাপদ। প্রয়োজনে পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে কিংবা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বা ফিটকারি ব্যবহার করে পান করতে হবে।

৬. যে কোনো দুর্ভোগের সময় ছোট শিশুদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, গর্ভবর্তী নারী ও বৃদ্ধদের প্রতি অধিক যত্নশীল হতে হবে।

৭. ন্যাকালীন সময়ে যাতায়াতের জন্য নৌকা না থাকলে কলাগাছের ভেলা তৈরি করে নিতে হবে। 

৮. পরিবারের সকল সদস্যকে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. আশ্রয়কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে।

১০. আশ্রয়কেন্দ্রে ল্যাট্রিন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা যাতে যথাযথ থাকে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

১১. নিজের সুযোগ-সুবিধাকে বড় করে না দেখে, সবার প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ করতে হবে।

 

দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে করণীয়

১. বন্যার পানি নেমে গেলে বা ঝড় পুরোপুরি থেমে গেলে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে হবে।

২. ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে ঝড় থেমে যাবার পর পরই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যেতে নেই। কারণ একবার ঝড় থেমে যাবার কিছুক্ষণ পর আবার উল্টো দিক থেকে তীব্র বেগে ঝড় প্রবাহিত হয়ে আঘাত হানতে পারে। দেখা গেছে উল্টো দিকের ঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের পানি তীরের সবকিছু সমুদ্রের বুকে টেনে নেয়।

৩. ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও মেরামত করে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে, এজন্য প্রয়োজনে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে।

৪. দুর্যোগে কেউ আহত হলে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। আঘাত গুরুতর হলে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিতে হবে এবং সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. কোনো ব্যক্তি মারা গেলে, লাশ উদ্ধার করে যত দ্রুত সম্ভব তা সমাহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত পশুপাখিও মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।

৬. বাইরে থেকে ত্রাণ ও চিকিৎসক দল এলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে সাহায্য পায় সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে।

৭. দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমাজের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

 

নদীভাঙন মোকাবিলার প্রতি
কোথাও নদীভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিলে প্রথমেই জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। কোথায় আশ্রয় নেওয়া যায় তা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে। তাছাড়া সময় থাকতে শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী, প্রসূতি ও প্রতিবন্ধীদের নিরাপদ আশ্রয়ে বা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে। বাড়ির হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখতে হবে। ঘরের মূল্যবান সামগ্রী ও দলিলপত্র আগে থেকে নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। নদীভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিলে প্রয়োজনে বাড়ির গাছপালা, শাকসবজি বিক্রি করে দিতে হবে। আগে থেকেই গোয়ালঘর ও রান্নাঘর নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। ভাঙন কাছাকাছি আসার আগেই থাকার ঘর নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। নদীভাঙনের আগেও আমরা কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারি, যা আমাদেরকে নিরাপদ রাখবে। নদীর পাড়ে কোনো কিছু নির্মাণ করতে হলেও তা এমনভাবে করতে হবে যেন সেটা সহজেই সরিয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া নদীর পাড়ে এমন ধরনের গাছ লাগাতে হবে যেগুলোর শিকড় মাটির খুব গভীরে চলে যায়। নদীতে চলাচলকারী বিভিন্ন জলযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাতে এসব যান নদীতে প্রবল ঢেউ সৃষ্টি না করে। নদীভাঙনের উপক্রম দেখলে আমাদের সব সময় নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নদীভাঙনের পরে আমাদের ক্ষতিপ্রয়দের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের বাড়িঘর নির্মাণে সহায়তা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের যেসব স্থানে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো মেরামত করতে হবে।

 

খরা মোকাবেলার প্রস্তুতি

আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে অনেক সময় ধরা হতে দেখা যায়। খরা মোকাবিলায় আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারি, যেমন খরার আগে এসব অঞ্চলে পুকুর ও খাল খনন করতে হবে। তাছাড়া যেখানে যেখানে সম্ভব বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ মওজুদ রাখতে হবে। একইভাবে গবাদি পশুর জন্যও খাবার মশুজ্জুদ করে রাখা প্ররোজন। এলাকার গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হবে। যেসব ফসল চাষে খুব বেশি পানির দরকার হয় না খরাপ্রবণ এলাকার সেসব ফসল চাষ করতে হবে। খরার ফলে বিপর্যন্ত পরিবারগুলোর জন্য বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতে হবে। এ সময়ে পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ এড়াতে গবাদি পশুকে পুকুর থেকে দূরে রাখতে হবে। খরা কেটে যাবার পর কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের বদলে জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। আগাছা ও জঞ্জাল পরিষ্কার করে জমিতে পানির অপচয় কমাতে হবে। এ সময়ে গভীর করে জমি চাষ করতে হবে। মাটির গভীরে শিকড় প্রবেশ করে এমন ফসল চাষ করতে হবে এবং বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।

 

ভূমিকম্প মোকাবিলায় করণীয়
বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চল বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে আছে। এগুলোকে বলা হয় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। যেমন- দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, টাংগাইল, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। দেশের অন্যান্য এলাকাগুলোতেও যে ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই তা নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প সম্পর্কে আগে থেকে কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তারপরও ভূমিকম্প মোকাবিলা অর্থাৎ ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিতে পারি সেগুলো হলো :

ভূমিকম্পের আগে প্রস্তুতি
বাড়িতে প্রধান দরজা ছাড়াও জরুরি অবস্থায় বের হওয়ার জন্য একটি বিশেষ দরজা থাকা প্রয়োজন । এছাড়াও বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী, হেলমেট, টর্চ প্রভৃতি মওজুদ রাখতে হবে। ভূমিকম্পের সময় আশ্রয় নেওয়া যায় বাড়িতে এমন একটি মজবুত টেবিল রাখতে হবে। ঘরের ভারি আসবাবপত্র মেঝের উপরে রাখতে হবে। ব্যবহারের পর বৈদ্যুতিক বাতি ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে রাখতে হবে। ভূমিকম্প চলাকালীন কোনো শক্ত টেবিল কিংবা শক্ত কাঠের আসবাবপত্রের নিচে অবস্থান নিতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘরের মধ্যে থাকতে হবে। অবিলম্বে সকল বৈদ্যুতিক সুইচ ও গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। তবে বাড়ির আশেপাশে যদি যথেষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা থাকে তবে সম্ভব হলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে উক্ত খোলা জায়গায় চলে যেতে হবে। ট্রেন, বাস বা গাড়িতে থাকলে চালককে তা থামাতে বলতে হবে। ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা যাবে না। ভূমিকম্প হওয়ার পরে আহত লোকজনকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধ্যমতো উদ্ধার কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে হবে। এ ব্যাপারে ফায়ার ব্রিগেড অর্থাৎ অগ্নিনির্বাপক দল ও অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্য নিতে হবে । দুর্গত মানুষের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র, খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

কাজ-১ : বন্যার সময় কীভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেতে পারে বলে তুমি মনে করো ?

কাজ-২ : বন্যার পর তোমার এলাকায় দুর্গত মানুষের সাহায্যে তুমি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারো তার একটি তালিকা তৈরি করো।

কাজ-৩ : হঠাৎ ভূমিকম্প অনুভব করলে তুমি আত্মরক্ষার জন্য কী কী করবে?

Content added By